* জেলায় জেলায় ডেঙ্গু আতঙ্ক, বাড়ছে রোগী ও মৃতের সংখ্যা
* হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না রোগীদের
* আইসিইউ-এর জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনেরা
গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রচলিত নিয়ম ভেঙে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। আইসিইউ-এর জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন স্বজনেরা। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই মিলছে না ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের। জেলায় জেলায় বাড়ছে ডেঙ্গুর আতঙ্ক, বাড়ছে রোগী ও মৃতের সংখ্যা। দেশজুড়ে বাড়ছে স্বজন হারানোর আহাজারি। এককথায় বলতে গেলে দীর্ঘদিন যাবত এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সাথে লড়ছে বাংলাদেশ।
জানা গেছে, ২০০০ সাল থেকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সাথে লড়ছে বাংলাদেশ। তবে ২৫ বছরে ডেঙ্গুকে জয় করার পরিবর্তে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করেছে সংশ্লিষ্ট খাতগুলো। ২০১৯ ও ২০২৩ সাল ছিল এ লড়াইয়ের টার্নিং পয়েন্ট। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ডের বছর ২০২৩ ছিল মশার বিরুদ্ধ পরাজয়ের এক মাইলফলক। একই অবস্থা ছিল ২০২৪ সালেও। আর ২০২৫ সালে সংক্রমণ ও মৃত্যু তুলনামূলক কমলেও তা এযাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তবে বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় চলতি বছরেও ডেঙ্গু সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে হাসপাতালগুলো। রাজধানীসহ অন্যান্য শহুরে জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে গ্রামে। এরই মধ্যে একই মশাবাহী চিকনগুনিয়া ও প্রথম বারের মতো জিকা ছড়িয়েছে দেশে। হাসপাতালে রোগীর চাপ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে রোগীদের বিপত্তি, সরকার পতনের পর স্থান প্রশাসনে স্থবিরতা ভুগিয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের। তবে চলতি বছরে হাসপাতালে সিট সংকট, ডাব-স্যালাইনের সিন্ডিকেট, রোগীদের জিম্মি করে ওষুধের দাম বৃদ্ধির মতো ঘটনা তেমন শোনা যায়নি। সর্বশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দেশে ২৪ ঘণ্টায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হন তারা। আর এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৩৬ জন। গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সব মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে ১৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৮ হাজার ৫২৭ জন। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৩১ জন, চট্রগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৯২ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৩১ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০৫ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৭ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২৯ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩৪ জন, রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭ জন এবং সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। তবে অধিদফতরের তথ্যমতে, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে জুলাই মাসে। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিন জন, এপ্রিলে সাত জন, মে মাসে তিন জন, জুন মাসে ১৯ জন, অগাস্ট মাসে ৩৯ জন মারা যান। ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ২৩ জন। মার্চ মাসে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। এছাড়া এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি, ১০ হাজার ৬৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জানুয়ারিতে ১১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১৭৭৩ জন, এ ছাড়া জুন মাসে ৫৯৫১ জন, অগাস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫২০৬ জন রোগী। ডেঙ্গু নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১৭৯২ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৪৬ জন, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ১০৪৬ জন। ২০০০ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১০ জেলায় সর্বোচ্চ রোগী পাওয়া গেছে। এই ১১ জেলায় রোগী পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৩৯৮ জন। দুই মাস আগে গত ১৫ এপ্রিল এসব জায়গায় রোগী ছিল এক হাজার ৪৩৪ জন। সে হিসেবে এই দুই মাসে রোগী বেড়েছে চার গুণের বেশি।
হটস্পট বরগুনায় আবারো বাড়ছে ডেঙ্গু: বরগুনায় ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করায় হটস্পট ঘোষণা করে স্বাস্থ্য বিভাগ। এতে কিছুদিন ধরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলেও আবারো বেড়েছে শঙ্কা। এ বছর মে এবং জুন মাসে বরগুনায় সবথেকে বেশি রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। ওই সময় প্রতিদিন প্রায় ৮০-১০০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হলেও গত এক মাস ধরে কিছুটা কমতে শুরু করে রোগীর সংখ্যা। অনেক উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। তবে বর্তমানে জেলায় প্রতিদিন প্রায় ৩৫-৪০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় সেপ্টেম্বর মাসে আবারো ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির শঙ্কা প্রকাশ করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে বর্তমানে ১০১ জন আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। বরগুনা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৩ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫ হাজার ৯৩২ জন। তবে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জেলায় আরও অন্তত ৩৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে সদর উপজেলার পর পাথরঘাটা উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা সবথেকে বেশি। এ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৪৪৭ জন। এ বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট ৬ হাজার ৮০ জন রোগীর মধ্যে শুধু জেনারেল হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছেন ৫ হাজার ৪২ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪ হাজার ৯৮৯ জন। বাকি পাঁচ উপজেলায় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ১ জন। এসময় জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৪৩ জন মারা গেছেন। এদের মধ্যে মধ্যে ৩৬ জনের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলায়, তিনজনের বাড়ি বেতাগী উপজেলায় এবং ৩ জনের বাড়ি পাথরঘাটা ও এক জনের বাড়ি বামনা উপজেলায়। বরগুনা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রেজওয়ানুর আলম বলেন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস সাধারণত ডেঙ্গু পিক সিজন হলেও এ বছর বরগুনায় জুন-জুলাই থেকেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। চিকিৎসকদের অক্লান্ত চেষ্টায় সুস্থের হার বাড়লেও আবারো ডেঙ্গু বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকছে। এর ফলে সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের লার্ভি সাইড ও এডাল্টি সাইড কার্যক্রম জোরদার করা উচিত। এছাড়া সকল রোগীকে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে। অল্প কিছু জটিল রোগী ছাড়া বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রান্তিক পর্যায়ে আক্রান্তের হার শহরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গ্রাম থেকে আসা রোগী শহরে এলে তাকে কামড়ানো মশার মাধ্যমে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ বছর সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে বরিশাল জেলায়— যা উদ্বেগজনক। তাই চোখ লাল, পেটে পানি আসাসহ এমন লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল ডা. তানভীর আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু শুধু শহরের রোগ নয়। এখন এটা গ্রামেও হচ্ছে। যোগাযোগের উন্নতি হওয়ায় মানুষ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এতে ধরুন, ঢাকায় কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গ্রামে গেলে সেখানে তাকে মশা কামড়িয়ে আরেকজনকে কামড়ালে তারও ডেঙ্গু হবে। তিনি বলেন, রোগীর হঠাৎ প্রলাপ বকা শুরু করা, অবচেতন হয়ে পড়া, শ্বাসকষ্ট বা প্রেসার ডাউন হওয়ার মতো সমস্যাগুলো উদ্বেগজনক লক্ষণ। এসব সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। নিয়মিত কীটনাশক ছিটানো, পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও দ্রুত রোগী শনাক্তের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জাবির কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন,গত বছরেই আমরা বলেছিলাম বরিশাল, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। এর কারণ হলো, আমরা জরিপ করতে গিয়ে দেখেছি প্রাদুর্ভাব হওয়ার তিনটি উপাদান হোস্ট (মানুষ), প্যাথোজেন (ডেঙ্গু ভাইরাস) এবং এনভায়রনমেন্ট (এডিস মশার প্রজণনের উপযোগী পরিবেশ)-এই তিনটিই অনুকূলে ছিল। তখনই আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল এন্ড ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুল হক বলেন, বাচ্চার বেশি পেট ব্যথা বা বমি হলে অথবা বাচ্চা আগের চেয়ে বেশি প্রস্রাব করলে তাদের অভিভাবকদের বলবো, বাচ্চাকে বাসায় রাখার কোনো সুযোগ নেই। শিশুরা নিজেদের শারীরিক অবস্থা বোঝাতে সক্ষম না হওয়ায় অভিভাবকদের বেশি সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বার বার ফোনে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

আরও ৫ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৬৩৬
ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু, বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা
- আপলোড সময় : ১৬-০৯-২০২৫ ০৬:৫৯:৪৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৬-০৯-২০২৫ ০৬:৫৯:৪৭ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ